নাজমুল হক খান :
উচ্চ শিক্ষা শেষ করে চাকরি না পেয়ে কমলা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, পাটকেলঘাটার সারুলিয়া গ্রামের ওবায়দুর রশীদ মুনমুন । সমতল ভূমিতে দার্জিলিং জাতের কমলা চাষে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন তিনি।বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক শামসুজ্জামানের অনুপ্রেরণা নিয়ে ২০১৯ সালে  দশ বিঘা জমির পরিকল্পনা নিয়ে, প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪ বিঘা জমিতে তিনি কমলা গাছ রোপন করেন। গত বছর থেকে ফল বিক্রি শুরু হলেও এবার গাছে প্রচুর ফলন এসেছে। গত ১৫ নভেম্বর থেকে বানিজ্যিক ভাবে কমলা বিক্রি শুরু হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী প্রতিদিন কমলার বাগান দেখতে আসছেন।
সরেজমিন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার সরুলিয়া গ্রামে যেয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০ বিঘা জমিতে শক্ত করে চারিদিকে বেড়া দিয়ে দার্জিলিং ও পাকিস্তানি জাতের কমলালেবুর চাষ করা হয়েছে। তবে সব জমিতে এখনো ফল আসেনি। ৪ বিঘা জমিতে প্রচুর পরিমাণ ফল ধরেছে।কিছু কমলার রং আসলেও অধিকাংশ ফল সবুজ বর্ণের।বাগানে  প্রতিদিন ৩ জন শ্রমিক পরিচর্যার কাজ করছেন।তবে বাগানের মাটিতে প্রচুর পরিমানে ঝরে পড়া ফল দেখা যায়। বিভিন্ন রোগবালাইয়ের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে জানা যায়। ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রী হলেও এবার প্রায় ১০ লাখ টাকার কমলা বিক্রি হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
 প্রতিটা গাছে আনুমানিক ২০ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত ফল পাওয়া যাবে। ১ বিঘা পরীক্ষামূলক পাকিস্তানি ও ৯ বিঘা জমিতে দার্জিলিং কমলালেবুর চারা রোপন করা হয়েছে। ৬ বিঘা জমিতে লাগানো গাছে এখনো ফলন আসেনি । চারা লাগানো পর সাধারণত ৪ বছর পর মুকুল আসতে  শুরু করে । তবে সার্বক্ষণিক পরিচর্যা করতে হয়। নিয়মিত কিটনাশক সহ বিভিন্ন ধরনের সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি বিঘা জমিতে বছরে পরিচর্যা বাবদ ১ লক্ষ্য টাকা খরচ করতে হয়।
ওবায়দুর রশীদ মুনমুন বলেন, মাস্টার্স ডিগ্রী শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা তদবির করেছি কিন্তু ভাগ্যে না থাকলে কি করব । তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চাকরিতে আর কত টাকা বেতন দিবে? তার চেয়ে বেশি টাকা ইনকাম হবে ভালো কৃষি উদ্যোক্তা হতে পারলে ।
আমার বাবা শামসুজ্জামান মোড়ল অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। পাশাপাশি তিনি একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা । পিতার অনুপ্রেরণা ও ইউটিউব দেখে উদ্বুদ্ধ হই কমলা চাষের প্রতি । আল্লাহর উপর ভরসা করে কমলা চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি ।
মোট ১০ বিঘা জমিতে চাষ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজে নেমেছি । আশাকরি এ বছর ৪ বিঘা জমির কমলা ১০ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব। আগামী বছর আরও ৫ বিঘায় ফলন আসবে। এক বিঘায় রোপন করেছি পাকিস্তানী জাতের কমলার চারা। তবে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস থেকে কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় অনেক সমস্যা হচ্ছে । কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহযোগিতা পেলে আমি আরো উন্নতভাবে চাষাবাদ করতে পারব ইনশাআল্লাহ । ফলন ভালো হলেও পোকামাকড়ের আক্রমণে অনেক কমলা ঝরে পড়ছে । আবার কিছু কমলার রস শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে । এ কারণে সকাল বিকাল সেচের পানি দিয়ে কমলা ভিজিয়ে দিতে হয়।উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ব্লক সুপারভাইজার মাঝে মধ্যে বাগান পরিদর্শনে আসলেও তিনি রোগের বিষয়ে তেমন কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছেন না। কারণ কমলা চাষের উপর তাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষন নেই । ২ বছর আগে কৃষি অফিস একবার ৩ দিনের একটা প্রশিক্ষনের জন্য ডাকলেও সেখানে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক না থাকায় কিছুই শিখতে পারিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা ইকতিয়ার হোসেন বলেন,বাড়ির পাশে বাগান থাকায় প্রায়ই দু’একটা কমলা লেবু খাওয়া পড়ে।স্বাদে গন্ধে অরিজিনাল দার্জিলিং কমলা লেবু  । খেতেও অনেক মিষ্টি ও সুস্বাদু । লেবুর সাইজ ও কালার অবিকল কাস্মীরী-দার্জেলিং কমলার মতো । রসে টসটসে খোসা ছিলে খেয়ে কেউ বলতে পারবে না,  এটা এদেশের মাটিতেই ফলানো কমলালেবু।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক শামসুজ্জামান মোড়ল বলেন ,অবসর নেওয়ার পর আমার নিজের জমিতে কিভাবে উর্বর করে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা যায়, সে লক্ষ্য কাজ করে আসছি। বিভিন্ন জাতের ধান বিজ উৎপাদন সহ এলাকার মধ্যে আমিই প্রথম আম্রপালি আমের বাগান করি । কয়েক বছর মধ্যে আমার দেখাদেখি কৃষক যখন এলাকায় ব্যাপক হারে আম চাষ শুরু করে, আমি তখন অন্য কিছু করার পরিকল্পনা করি। এর মধ্যে আমার একমাত্র ছেলে মুনমুন লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। আমি তাকে কৃষি কাজ করতে অনুপ্রেরণা দেই। একপর্যায়ে মুনমুন কমলা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়।
 ঠাকুরগাঁও জেলার পিরগঞ্জ রাসেল নার্সারি থেকে চারা এনে আমার লাগানো সেই আম গাছ গুলো কেটে ফেলে সেখানে দার্জিলিং জাতের কমলার চারা রোপন করার পরামর্শ দিই । গত বছর ১ লক্ষ টাকার কমলা বিক্রি করেছিল মুনমুন । এবার ভালো দাম পেলে ১০ লক্ষ্য টাকার কমলা বিক্রি করা যাবে।
কৃষি উপ-সহকারী পিজুস কান্তি পাল বলেন,আমি কৃষি উদ্যোক্তা মুনমুনকে কমলা বাগান শুরু করা থেকে বিভিন্ন ভাবে পরামর্শ দিয়ে আসছি। তবে এ চাষের উপর আমাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও  রোগবালাই সহ নানান সমস্যার সমাধান করতে পারছি না।
তালা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, হাজিরা খাতুন বলেন, পাহাড়ের কমলা সমতল ভূমিতে চাষ করে উপজেলার সরুলিয়া গ্রামের কৃষক মুনমুন সফল হয়েছেন। তার মতো তরুণ উদ্যোক্তাকে আমরা উৎসাহিত করছি । তবে এ অঞ্চলে দার্জিলিং জাতের কমলা চাষের উপর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তেমন লোকবল  না থাকায় একটু সমস্যা হচ্ছে । এই সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন ।
মুনমুন বলেন ,কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা পেলে , আমি আরো উন্নত মানের কমলা চাষ করতে পারব এবং বিভিন্ন রোগের ঔষধ পাত্রের পরামর্শ পেলে আমার কমলা ঝরে যাবে না এবং লক্ষ লক্ষ টাকার কমলা দেশ  বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে ইনশাল্লাহ । আমি একান্তভাবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কাছে ,পরামর্শ ও ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করার জন্য একান্তভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি ।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *